সংখ্যালঘু ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা সংকটে বাংলাদেশ

মোট দেখেছে : 5
প্রসারিত করো ছোট করা পরবর্তীতে পড়ুন ছাপা

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা নানা ধরনের চাপে জীবনযাপন করে আসছে। তাদের জমি, সম্পদ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চা প্রায়ই হামলা ও বৈষম্যের শিকার হয়। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ডানপন্থার উত্থানের পর এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডানপন্থী রাজনীতি সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ও ধর্মকে প্রাধান্য দেয়, অন্যদিকে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিকে হুমকি হিসেবে দেখে। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মাজার, ওরস, বাউল উৎসব, নাটক বা চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা বেড়েছে।

খাগড়াছড়িতে ধর্ষণ, বিক্ষোভ ও গুলিতে প্রাণহানি

২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক মারমা কিশোরী প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনজন বাঙালি যুবকের হাতে ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় পুলিশ শয়ন শীল (২১) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে।

অন্য দুই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের দাবিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে। ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে তারা স্কুল-কলেজ বর্জন, মহাসমাবেশ ও সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। আন্দোলনের সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, এবং সেটলার বাঙালিদের একটি অংশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সহিংস রূপ নেয়।

সহিংসতায় খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার তিন তরুণ নিহত হন—আথুই মারমা (২১), আথ্রাউ মারমা (২২) ও তৈইচিং মারমা (২০)। স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনের বেলায় দোকানপাট ও বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যার অধিকাংশ মালিক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ।

গুজব ও উসকানি পরিস্থিতি জটিল করেছে

ফ্যাক্টচেক সংস্থা ‘রিউমর স্ক্যানার’ ও ‘ডিসমিসল্যাব’-এর তথ্যমতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পুরনো ভিডিও ও ভুয়া খবর ছড়িয়ে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হয়। এসব গুজবের মধ্যেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

রাষ্ট্রের ভূমিকা ও সমালোচনা

অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “এই ঘটনার পেছনে বিদেশি প্রভাব বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধন থাকতে পারে।” তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া এমন মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে।

কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলে সংখ্যালঘু নারীদের ওপর নিপীড়নের ২৪টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২১টি পাহাড়ে, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিচারপ্রক্রিয়া অনিশ্চিত অবস্থায় আছে।

বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি

স্থানীয় অধিকারকর্মীরা বলছেন, মারমা কিশোরীর ধর্ষণ মামলার মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যা অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। অতীতের অভিজ্ঞতা, যেমন ২০১৮ সালের বিলাইছড়ি ধর্ষণ মামলা কিংবা তনু হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় বিচার না হওয়ায় মানুষের আস্থা আরও কমেছে।

তারা মনে করেন, পাহাড়ে ধর্ষণ বা সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এর সঙ্গে জাতিগত নিপীড়নের সম্পর্ক আছে। তাই এই ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্ত, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তুলেছে বিভিন্ন সংগঠন।

পাহাড়িদের দাবি: নাগরিক অধিকার ও ন্যায়বিচার

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং নাগরিক অধিকার ও প্রশাসনিক সমতা চান। “সমতল থেকে পাহাড়— এবারের মুক্তি সবার” — গণ-অভ্যুত্থানের সময়কার এই স্লোগানটি আবারও আলোচনায় এসেছে।

তাদের মতে, পাহাড়ের উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে সমগ্র দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাও আসবে না।